Monday, December 4, 2023

ফিতা ক্যাসেট যেভাবে হারিয়ে গেল || কেস স্টাডি

 



ছবির জিনিসটা কি চিনতে পারছেন? যাদের জন্ম ২০০০ সালের পরে তাদের হয়তো চিনতে একটু অসুবিধা হবার কথা। তবে তার আগের মানুষদের জন্য এটা নস্টালজিয়া! স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে আশি ও নব্বইয়ের দশককে বলা যেতে পারে ক্যাসেট যুগ! অনেকটা দেশীয় শিল্পীদের হাত ধরে ক্যাসেটের প্রচলন শুরু হয়। ১৯৮০ সালের শুরুতে গানের অ্যালবাম ক্যাসেট আকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের প্রথম ক্যাসেট অ্যালবামের গায়ক ছিল শোয়েব। ১৯৮২ সালে সোলস ব্যান্ড হিসেবে সর্বপ্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম ‘সুপার সোলস’ প্রকাশ করে। একই বছর ব্যান্ড মাইলস তাদের প্রথম এলব্যাম ‘মাইলস’ নামে প্রকাশ করে, যার গানগুলো ছিল ইংরেজি।


প্রথমদিকে আর্টিস্ট, ব্যান্ড নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে গান রেকর্ড করে ক্যাসেট তৈরি, বিক্রির উদ্যোগ নেয়। ধীরে ধীরে এটি ইন্ডাস্ট্রিতে রূপ লাভ করা শুরু করে। এর মধ্যে নব্বইয়ের দশককে অডিও ক্যাসেটের স্বর্ণযুগ বললে ভুল বলা হবে না। বিভিন্ন উৎসব বিশেষ করে ঈদের আগে সবাই ক্যাসেট রিলিজ করার চেষ্টা করতো। আর মানুষ অপেক্ষায় থাকতো তার প্রিয় শিল্পীর ক্যাসেট কেনার জন্য। অঞ্চলভেদে একাধিক দোকান থাকতো। কেউ ঢাকা থেকে ক্যাসেট এনে জেলা শহরে পাইকারি সেল করতো, সেখান থেকে খুচরা দোকানে সেল হতো ২৫ থেকে ৫০ টাকা দরে। ক্যাসেটের দোকানে সারাদিন গান বাজতো, মানুষ গান শুনে সেই ক্যাসেটের প্রতি আগ্রহী হতো। এই গান বাজানো ছিল এক ধরনের বিজ্ঞাপন। মানুষের সাথে গানটি পরিচিত করিয়ে দিয়ে তাকে আগ্রহী করে তোলা। অনেকে পুরো ক্যাসেট কিনতো আবার মানুষ পছন্দ অনুযায়ী ব্ল্যাংক ক্যাসেট কিনে পছন্দের গানের লিস্ট করে রেকর্ড করে নিত দোকান থেকে। আমি নিজেও করেছি। এক রমরমা অবস্থা ছিল। ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শোনার কিছু অসুবিধাও ছিল! যেমন ক্যাসেটের ফিতা আটকে যাওয়া! খুব সতকর্তার সাথে ক্যাসেটের ফিতা হেড থেকে টেনে বের করতে হতো। একটু এদিক ওদিক হলে ক্যাসেট নষ্ট হয়ে যেতো। আবার পছন্দের গান শোনার জন্য সময় নিয়ে বারবার রিওয়াইন্ড, ফরোয়ার্ড করতে হতো।

গানের প্রচারণার ক্ষেত্রে সরাসরি সম্পর্কিত নয় এমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও কিন্তু বেশ বড় ভূমিকা রেখেছিল! আপনারা কি ভাবছেন সেই প্রতিষ্ঠান কোনটি? সেটা হলো পাড়ার সেলুনগুলো! হ্যাঁ সেলুনে সারাদিন গান বাজতো, সেলুনে অপেক্ষারত সেবাগ্রহীতা পেপার পড়ার পাশাপাশি গানও শুনতো এবং সেসব নিয়ে আলোচনাও চলতো। শুধুমাত্র গান শোনার জন্য যে অডিও ক্যাসেট ব্যবহৃত হতো তা না; বরং কৌতুক, কবিতা আবৃত্তি, ওয়াজ মাহফিলের ক্যাসেটও বিক্রি হতো। তাছাড়া সাক্ষাৎকার রেকর্ডও করা হতো ছোট ধরনের অডিও ক্যাসেটে। তারপর সময় বদলে গেল। এরপর আসলো সিডি প্লেয়ারের যুগ। সেটাও ধুমসে বিক্রি হলো, ধীরে ধীরে ক্যাসেটের চাহিদা কমতে থাকার সাথে সাথে ক্যাসেট শোনার যন্ত্র ক্যাসেট প্লেয়ার বা টেপ রেকর্ডারও বাজার থেকে হারিয়ে গেল। আর সিডি প্লেয়ারের সুবিধাও ছিল অনেক। সাইজে ছোট, ক্যাসেটের ১২ টি গানের তুলনায় গানও ধরতো অনেকগুলো। এই ইন্ডাস্ট্রিতে সবচেয়ে বড় ধ্বসের কারণ ছিল অডিও পাইরেসি ও এমপিথ্রি প্লেয়ার! অডিও পাইরেসির জন্য কোম্পানিগুলো আর ক্যাসেট বের করতে আগ্রহী হচ্ছিল না, শিল্পীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হলো। আর শেষ পেরেকটি মেরে দিলো এমপিথ্রি প্লেয়ার! ক্যাসেট/সিডির পরিবর্তে গান লোড করার দোকানের সংখ্যা বাড়লো। সাথে তৈরি হলো নতুন ভোক্তা। ২০,৩০,৫০ টাকা দিয়ে অসংখ্য গান লোড করে নেয়া যেত মেমোরি কার্ড নামের ছোট একটা স্টোরেজে। এমপিথ্রি প্লেয়ার মোবাইলে করে ঘুরতে থাকলো শত শত গান। আর এভাবেই গ্রামোফোন এর পরবর্তী প্রজন্ম ক্যাসেট, সিডি এবং তার সাথে অডিও ইন্ডাস্ট্রি অনেকটা ধ্বংসের দারপ্রান্তে চলে গেল। কিছু লক্ষনীয় বিষয়:  প্রযুক্তির পরিবর্তনের সাথে আমাদের খাপ খাওয়ানোর মানসিকতা থাকতে হবে এবং নিজেদের কাজের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনতে হবে।  বাজার ব্যবস্থা এবং গ্রাহকের অভ্যাস পরিবর্তনের কারণে এক সময়ের রমরমা ব্যবসা বছর কয়েকের ব্যবধানে হারিয়েও যেতে পারে।  আপনার ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত নয় কিন্তু আপনার ব্যবসার প্রচারের কাজে লাগবে এমন প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে তাদের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। সম্ভব হলে আপনি নিজেই তাদের সহযোগিতা করতে এগিয়ে যান।  ক্যাসেট, সিডি হারিয়ে গেলেও গান শোনা কিন্তু বন্ধ হয়নি। ধীরে হলেও এখন বিভিন্ন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম যেমন জিপি মিউজিক, গান অ্যাপ, স্পটিফাইয়ের, ইউটিউবের মতো সার্ভিস ব্যবহার করে মানুষ গান শুনছে। প্রায় সবগুলোই পেইড প্ল্যাটফর্ম এবং পেমেন্ট দেয়ার পদ্ধতিগত জটিলতায় মানুষ খুব একটা আগ্রহী হয়ে উঠে না। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো শ্রোতাদের ফ্রি-তে গান শোনার মানসিকতার কারণে এই প্ল্যাটফর্মগুলোও সফলতার মুখ দেখছে না।


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: